পরিবর্তনের প্রত্যয়ে নিরন্তর পথচলা...
মানবসভ্যতা গড়িয়েছে বহু বহু বছর। এই অযুত নিযুত অর্বুদ বছর যাবত মানুষ মানুষের সাথে মিশছে, মানুষ মানুষকে জানছে-বুঝছে, মানুষ মানুষকে নিয়ে গবেষণা করছে- তবুও রহস্যময় মানুষ! এক কথায় বলতে গেলে মানুষ অসম্ভব রকম ক্ষমতা সম্পন্ন। পৃথিবীর ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত যা যা কিছু অসম্ভব ছিল- এখন তার অনেক কিছুই সম্ভবের মধ্যে। এই অসম্ভবগুলো সম্ভব করেছে মানুষ। এক সময় যার জন্ম ছিল প্রশান্ত বা আটলান্টিক মহাসাগরের কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে, তার কাছে বিস্তীর্ণ জলরাশিই ছিল পৃথিবীর প্রান্ত! মানুষ এখন দিনের মধ্যেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পারে। শুধু কি পৃথিবী! মানুষ ছাড়িয়ে গেছে গ্যালাক্সি। আরও যত অসম্ভবরা আছে তারাও একদিন সম্ভব হবে মানুষের কাছে। দূর্ঘটনায় কিছু না খোয়ালে গড়পড়তা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং এর বিন্যাস সবারই এক, তবু কত বৈচিত্রময় মানুষ। একই মুহূর্তে একই বয়সের কেউ মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, আবার কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কেউ একজনের দিকে একটা ঢিল ছুড়েই প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগছে, আবার কেউ বোমা মেরে সহস্র মানুষ হত্যা করে আরও সহস্র মানুষ হত্যা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরকম কেন হয়? আমরা সবাই মানুষ, পার্থক্য শুধু যোগ্যতায়। কেউ মানুষ হিসেবে অনেক যোগ্য হতে পেরেছি, কেউ একদমই হতে পারিনি। কথা হলো, একজন মানুষকে কখন যোগ্য মানুষ বলবো? সাধারণত আমরা মনে করি, একজন মানুষ কতটা যোগ্য মানুষ হবে সেটা নির্ভর করে চারটি বৈশিষ্ট্যের উপরে। বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে – চিন্তাশীল হওয়া, ইতিবাচক থাকা (হতাশ না হওয়া), আত্মবিশ্বাসী হওয়া এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা। এই চারটি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে যত প্রকট আকারে থাকবে সে তত যোগ্য মানুষ হবে। আমরা যদি উদ্ভাসের লোগোটা ভালো করে লক্ষ্য করি- দেখবো; চার রঙ এর চারটি শিখা রয়েছে। এই চারটি শিখাই হচ্ছে- এই চারটি বৈশিষ্ট্য।
চিন্তাশীল হওয়া
এ আবার কেমন কথা, চিন্তা কে না করে। কথা সত্য, একদমই চিন্তা করে না- পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এখানে আমরা চিন্তা বলতে বুঝাচ্ছি – কারণ অনুসন্ধান করা, ‘কেন’ এর উত্তর খোঁজা, ভালো এবং মন্দের পার্থক্য করতে পারা, সত্য এবং মিথ্যার প্রভেদ করতে পারা। আমি যখন ভালো এবং মন্দের পার্থক্য করতে পারবো, অবশ্যই মন্দকে এড়িয়ে যাবো। যে সত্য এবং মিথ্যার প্রভেদ বুঝতে পারবে সে আর মিথ্যার আশ্রয় নিবে না। চিন্তাশীল মানুষেরা গভীরের কারণ অনুসন্ধান করে। গাছের আপেল কেন আকাশ পানে না গিয়ে ভূমিতে নেমে আসে, এই কারণ অনুসন্ধান করতে করতে নিউটন মহোদয় মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন। পাখি কীভাবে আকাশে ওড়ে মানুষ এই কারণ অনুসন্ধান করতে করতে প্লেন আবিষ্কার করে ফেলেছেন। আমাদের কাছে শিক্ষা মানে নিছক সার্টিফিকেট অর্জন বা কিছু ডিগ্রি নেয়া নয়। আমরা শিক্ষিত বলতে বুঝি আলোকিত মানুষ হওয়া, চিন্তাশীল হওয়া।
ইতিবাচক হওয়া
(হতাশ না হওয়ার অভ্যাস করা)
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল এবং অসফল মানুষদের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় হতাশ না হওয়ার অভ্যাস। অর্থাৎ যেকোনো ক্ষেত্রে বা যেকোনো কাজে যে কেউ যত বেশি সময় ধরে লেগে থাকবে সেখানে তার সফল হওয়ার সম্ভবনা তত বেশি। পবিত্র কোরআনে সূরা আল ইমরান এ আল্লাহ সুবহানুহু ওয়াতাআলা ইরশাদ করেছেন- “তোমরা হতাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও (সূরা আল ইমরান : ১৩৯)”। একজন যোগ্য মানুষের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি কোনো কিছুতে সহজেই হতাশ হবেন না। সেটা হতে পারে পড়ালেখার ক্ষেত্রে কোন কঠিন বিষয় বুঝতে পারছে না, সেটা নিয়ে লেগে থাকতে হবে। একইভাবে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই হতাশ না হয়ে লেগে থাকতে হবে, সফলতা আসবেই।
আত্মবিশ্বাসী হওয়া
আমরা বিশ্বাস করি মানুষ পরিবর্তনশীল এবং ক্রমবর্ধনশীল শুধু শরীরে নয়; চিন্তা এবং প্রজ্ঞায়। মানুষ এখন যা পারে, যতটুকু পারে সে আসলে এর থেকেও বেশি পারে। অর্থাৎ এখন যে ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে দৌঁড়াতে পারে এবং এটাকেই তার সর্বোচ্চ গতিবেগ মনে করছে , সে আসলে এর থেকেও বেশি বেগে দৌঁড়াতে পারে। নিজের প্রতি, নিজের যোগ্যতার প্রতি এরকম বিশ্বাস ধারণ করতে পারাই হলো আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিজের যোগ্যতা আড়াল হয়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে আমরা নিজের সম্পর্কে যে ধারণা করি, তার প্রভাব আমাদের শরীরের কোষগুলোর উপরও পরে। প্রতি মুহূর্তে আমরা যদি নিজেদেরকে দূর্বল ভাবি, তবে আমাদের কোষগুলোও দূর্বল হয়ে যায়। এজন্য আত্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আত্মবিশ্বাসী মানুষেরা শুধু নিজেরাই সফল হন তা নয়, তাদের দেখে আশেপাশের মানুষেরও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
মূল্যবোধ ও জবাবদিহিতা
সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা
আমরা প্রায়শই শুনে থাকি- মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, যুব সমাজ ধ্বসে যাচ্ছে। এই মূল্যবোধ বিষয়টা আসলে কী? কেন মূল্যবোধ এত গুরুত্বপূর্ণ? সামাজিক বিবর্তনের ধারায় কিছু রীতিনীতি ও আচার-আচরণ সমাজের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়। এসব সাধারণ নিয়ম সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখে। নিয়মগুলো ভঙ্গ করলে সমাজে শান্তি–শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়। এসব নিয়মকানুনগুলোই মূল্যবোধ বলা হয়। মূল্যবোধ কখনও প্রতিষ্ঠা করা যায় না, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। মূল্যবোধের উপাদান হিসেবে বলা যেতে পারে – নীতি ও ঔচিত্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, শ্রমের মর্যাদা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য, আইনের শাসন ইত্যাদি। মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই অবক্ষয়ের সূচনা করে। অবক্ষয় বলতে আমরা সাধারণত সামাজিক কিছু স্খলন বা চ্যুতি-বিচ্যুতিকেই বুঝি। যেমন- মাদকাসক্তি, পর্নোগ্রাফি আসক্তি, ছিনতাই, চুরি, রাহাজানি, ঘুষ- দুর্নীতি, অনিয়ন্ত্রিত-অন্যায্য এবং অপরিণত যৌনাচারসহ এ ধরণের সামাজিক অপরাধকে অবক্ষয় হিসেবে চিত্রিত করা হয়। বাস্তবে এর ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি বিস্তৃত। মূলত সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, নীতি ও ঔচিত্যবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা ইত্যাকার নৈতিক গুণাবলি লোপ পেলে, অবক্ষয়ের জন্ম হয়। মূল্যবোধ ও অবক্ষয় পরস্পর বিরোধী; সাংঘর্ষিক। তাই মূল্যবোধ যেখানে দুর্বল, অবক্ষয় সেখানেই প্রবল। আমরা যদি যোগ্য মানুষ হতে চাই অবশ্যই, আমাদের মধ্যে মূল্যবোধ থাকতে হবে। আমারা যারা নিজেদেরকে মানুষ হিসেবে দাবি করি অথবা দেখতে শুনতে পুরোটাই মানুষের মতো, আমাদের সবার মধ্যে অবশ্যই এই চারটি বৈশিষ্ট্য থাকতেই হবে। শুধু মানুষ হয়ে শত বর্ষ বেঁচে থাকার থেকে মানুষের মতো মানুষ হয়ে অর্থাৎ যোগ্য মানুষ হয়ে কিছু মুহূর্ত বেঁচে থাকাও শ্রেয়তর। আসুন! যোগ্য মানুষ হই।